ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫ , ১১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

​প্ল্যানিং ও ডিজাইন দপ্তরে আটকে আছে মানিকদিয়ার ভাগ্য!

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ২৫-০৬-২০২৫ ০৩:৩৭:৪৭ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ২৫-০৬-২০২৫ ০৩:৪৫:৪৮ অপরাহ্ন
​প্ল্যানিং ও ডিজাইন দপ্তরে আটকে আছে মানিকদিয়ার ভাগ্য!
রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ মানিকদিয়া। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সবুজবাগ থানাধীন এলাকাটি ২০২৫ সালে দাঁড়িয়েও অন্ধকারে ঢাকা। এখানে কিছু বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে, কিন্তু নেই কোনো বৈদ্যুতিক খুঁটি। খুঁটি ছাড়া ঝুলন্ত তারে চলছে ঘর-বাড়ি, দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ সংযোগ। আর সেটাই পরিণত হয়েছে এক ভয়াবহ মৃত্যুফাঁদে। গত ৭/৮ বছরে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে বেশ কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এখনো ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে মৃত্যুর আশঙ্কাও। 

এলাকাবাসীর আবেদনের পরও বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণের কোনো সুরাহা হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) প্ল্যানিং ও ডিজাইন দপ্তরের দুর্নীতির জালে আটকে আছে কাজটি। ঘুষ ছাড়া নড়ছে না একটি কাগজও। লিখিত আবেদন করার পরও আজ অবধি মাত্র ১২টি বিদ্যুৎ খুঁটি স্থাপন হয়নি এখানে। অথচ এই এলাকায় সহস্রাধিক পরিবার বসবাস করে, রয়েছে স্কুল, মসজিদ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসাকেন্দ্র। স্থানীয়দের ভাষায়, “বিদ্যুৎ ছাড়া আমরা আধুনিক ঢাকায় থেকেও আদিম জীবনে বসবাস করছি।”

জানা গেছে, ২০২৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ডিপিডিসির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ আল নোমানের কাছে শতাধিক স্থায়ী বাসিন্দা একটি লিখিত আবেদন দেন। জনদাবির বিষয়টি আমলে নিয়ে তিনি অধীনস্তদের দ্রুত কাজ শুরুর নির্দেশনা দেন । কিন্তু সেই ফাইলটির আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফাইলটি পড়ে আছে ডিপিডিসির প্ল্যানিং ও ডিজাইন দপ্তরে। যেখানে দেশের অন্যতম ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দপ্তর থেকে জানা গেছে, এলাকাবাসীর আবেদনটির গুরুত্ব কতটুকু এবং কীভাবে কাজটি সম্পাদন করা যায়- তার বিস্তারিত তথ্য চেয়ে সংশ্লিষ্ট মুগদা ডিভিশনে চিঠি পাঠানো হয়। পরবর্তীতে মুগদা ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী কাজটি সম্পাদনের জন্য বিস্তারিত তথ্য ও ডিজাইন প্রধান কার্যালয়ে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করে। ওই নথিতে ডিপিডিসির পিডিএসডি প্রকল্প থেকে কাজটি সম্পাদনের সুপারিশ করা হয়। পরবর্তীতে মতামতের জন্য নথিটি সংস্থার প্ল্যানিং ও ডিজাইন দপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) শ্রীবাস চন্দ্র বিশ্বাসের কাছে পাঠানো হয়।

সূত্র জানায়, শ্রীবাস চন্দ্র বিশ্বাস পতিত সরকারের দোসর। তার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক অভিযোগ।  তিনি উৎকোচ ছাড়া কোনো ফাইলে সুপারিশ করেন না। বিগত সময়ে বিভিন্ন ডিভিশন ও সার্কেল অফিসে কর্মরত থাকাকালীন তাঁর বিরুদ্ধে ছিল গ্রাহক হয়রানি, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ।  

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে বুধবার (২৫ জুন) শ্রীবাস চন্দ্র বিশ্বাসের মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে তিনি ফোন ধরেননি।

এদিকে, মুগদা ডিভিশনের এক প্রকৌশলী জানান, দক্ষিণ মানিকদিয়ায় ১২ স্প্যান বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণ করা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রধান কার্যালয় থেকে চিঠিটি পাবার পর আমরা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রধান প্রকৌশলীর জোরালো সুপারিশ সম্বলিত নথিটি নির্বাহী পরিচালকের (অপারেশন) কাছে প্রেরণ করি। পরবর্তীতে বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে তিনি মতামতের জন্য প্ল্যানিং ও ডিজাইন দপ্তরে পাঠান। কী কারণে নথিটি ওই দপ্তরে আটকে আছে, তা আপনারা খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। ওই প্রকৌশলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শুধু উন্নয়নকাজই নয়, যেকোনো গ্রাহকের উচ্চচাপ সংযোগ (বড়) ও বিদ্যুৎসেবার অন্যান্য কাজ প্ল্যানিং দপ্তরে মতামতের জন্য গেলেই ওখানে টাকা না দিলে ফাইল নড়ে না। মাসের পর মাস তারা ফাইল ফেলে রাখে। 

ডিপিডিসির একাধিক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘এই দপ্তরটি খুবই স্পর্শকাতর। ডিপিডিসির ৩৬টি ডিভিশনের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ ও অবকাঠামো বিষয়ক ফাইল মতামতের জন্য এখানে আসে। কিন্তু টাকা ছাড়া কিছুই হয় না। মাসের পর মাস ফাইল ফেলে রাখা হয় এখানেই।”

সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যুতের খুঁটি না থাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা বাধ্য হয়ে ২০০-৩০০ ফুট দূর থেকে ঝুঁকিপূর্ণ সার্ভিস তার দিয়ে বিদ্যুৎ টানছেন। ঝড়বৃষ্টির রাতে তার ছিঁড়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। বেশিরভাগ সময় তার ছিঁড়ে যাওয়ায় দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন থাকে এলাকা। স্থানীয় বাসিন্দা আবু তাহের বলেন,“আমরা এলাকাবাসী ১২ স্প্যান বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণের জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু ডিপিডিসির প্রকৌশলীরা কাজটি করে দিচ্ছে না। প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা শুধু টাকা চায়।” গৃহবধূ লাইলী বেগম বলেন, “ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যার পর পড়তে বসলে প্রায় সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। এখন বর্ষা মৌসুম, একটু বাতাস হলেই বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে যায়। এতে করে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি থাকে। একটা আবাসিক এলাকায় এমন অবস্থা, সেটা ভাবতেই পারি না।”

আরেক বাসিন্দা রোজিনা আক্তার বলেন, বর্ষা মৌসুমে আমরা বেশি দুর্ভোগে থাকি। দ্রুত লাইন নির্মাণ করে দুর্ভোগ লাঘবের জোর দাবি জানিয়েছেন তিনি।

স্থানীয় উদ্যোক্তা নজরুল ইসলাম বলেন,“ স্বল্পপুঁজিতে আমি একটি বুটিক হাউস চালাই। বিদ্যুৎ সমস্যার জন্য আমার প্রতিষ্ঠানটি অন্যত্র নিয়ে যেতে হবে। এর আগেও আরো কয়েকজন বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে তাদের ক্ষুদ্র শিল্প অন্য জায়গায় নিয়ে গেছেন। এতে এলাকায় অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে।”

উদ্যোক্তা হাবিবুর রহমান বলেন,  এখানে কোন প্রতিষ্ঠান করা সম্ভব না। কারণ এখানে বিদ্যুৎ নিয়ে সমস্যা আছে। তাই আমি এখানে কোন কিছু করি না।

এলাকাবাসী বলছেন, আমরা ভোট দিই, ট্যাক্স দিই, কিন্তু বিনিময়ে শুধু দুর্নীতি পাই। শ্রীবাস চন্দ্র বিশ্বাসদের মত দুর্নীতিবাজদের জন্যই আমাদের জীবন থেমে আছে। তাদের দাবি— অবিলম্বে বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণ করা হোক, দায়ী কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত করা হোক , কেন তিনি আমাদের ফাইল আটকে রেখেছেন। ডিপিডিসির প্লানিং ও ডিজাইন দপ্তর থেকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণ করে সৎ ও যোগ্য লোক বসিয়ে বিভাগটি সংস্কার করা হোক। 

সচেতন মহল দাবি তুলেছেন, একটা এলাকার উন্নয়ন শুধু রাস্তাঘাট দিয়ে হয় না—বিদ্যুৎ ছাড়া দৈন্দিন জীবন অচল। দক্ষিণ মানিকদিয়ার এই ভোগান্তি প্রশাসনের অজানা নয়। অতিসত্ত্বর এটার সমাধান হোক। 

এদিকে, পিডিএসডি প্রকল্পের একটি সূত্র বলছে, ৩৬টি ডিভিশনেই তারা উন্নয়ন কাজ করছে। প্ল্যানিং ও ডিজাইন দপ্তরে মতামতের জন্য নথি প্রেরণ করা হলে বেশিরভাগ সময়ই নানা টালবাহানা দেখিয়ে বিলম্ব করা হয়। এতে করে সরকারের উন্নয়নকাজ চরমভাবে ব্যহত হয়। দ্রুত প্ল্যানিং ও ডিজাইন দপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীসহ অন্যদের বদলি করে যোগ্য লোককে পদায়ন করা এখন সময়ের দাবি। অন্যথায়, ডিপিডিসির ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ণ হবে।

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, যদি দ্রুত  বিদ্যুতের খুটি বসানো না হয় তাহলে কঠিন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে। তারা গণস্বাক্ষর অভিযানে যাবেন, স্থানীয় প্রশাসন ও ডিপিডিসির কার্যালয়ে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি পেশ করবেন,  এমনকি তারা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দায়ের করবেন। একজন তরুণ সমাজকর্মী বলেন— ‘যদি শান্তিপূর্ণভাবে দাবি না মানা হয়, আমরা গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে এই দুর্নীতির চিত্র দেশবাসীর সামনে উন্মোচন করবো।”

ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালকের (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলাম বুধবার (২৫ জুন) বাংলাস্কুপকে বলেন, যদিও আমি ডিস্ট্রিবিউশন দেখি, কিন্তু এই কাজটি আমার নয়।  এসব উন্নয়নকাজ দেখেন নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল)। আপনি উনার সঙ্গে কথা বলেন। 
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ গ্রাহককে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। মানিকদিয়ার বিষয়টি যাতে দ্রুত সমাধান হয়, আমরা আন্তরিকভাবেই তা দেখব।

এ বিষয়ে জানতে ডিপিডিসির  নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) মোরশেদ আলম খানকে একাধিকবার মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি সংযোগ কেটে দেন। 

বাংলা স্কুপ/প্রতিবেদক/এনআইএন/এসকে


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স


এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ